মরু-ভাস্কর (তৃতীয় অধ্যায়) (হবীবুল্লাহ্ বাহার)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - সপ্তবর্ণা গদ্য | - | NCTB BOOK
292
292

যেসব মহাপুরুষের আবির্ভাবে পৃথিবী ধন্য হয়েছে মানুষের জীবনে যাঁরা এনেছেন সৌষ্ঠব, ফুটিয়েছেন লাবণ্য, মরুভাস্কর হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (স.) তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।

হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর জীবন আলোচনা করতে গিয়ে সকলের আগে আমাদের চোখে পড়ে তাঁর ঐতিহাসিকতা। হজরতের জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনা, প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিবরণ যেভাবে রক্ষা করা হয়েছে, সত্যের কষ্টিপাথরে ঘষে যেভাবে যাচাই করা হয়েছে, পৃথিবীর কোনো মহাপুরুষের বেলায় তা করা হয়নি।

আরবের লোকের স্মৃতিশক্তি ছিল সত্যি অসাধারণ। বিরাট বিরাট কাব্যগ্রন্থ সহজেই তারা মুখস্থ করে ফেলত। আরবি সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, মুখস্থ না করে কোনো কিছু লিখে রাখা আরবিরা লজ্জার কথা বলে মনে করত। সাহাবিরা এবং অন্য হাদিসজ্ঞরা অনেকেই হাজার হাজার হাদিস মুখস্থ করে রাখতেন।

হজরত মোস্তফা (স.) মানবতার গৌরব। আল্লাহর নবি হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজেকে সাধারণ মানুষই মনে করতেন এবং সেভাবেই তিনি জীবনযাপন করেছেন। ৬৩ বছরের ক্ষুদ্র পরিসর জীবনে হজরতকে কত পরিবর্তনের সম্মুখীন হতে হয়েছে, দেখলে অবাক হতে হয়। যিনি ছিলেন এতিম, তিনি হয়েছিলেন সারা আরবভূমির অবিসংবাদিত নেতা। হজরত যখন মদিনার অধিনায়ক, তখন তাঁর ঘরের আসবাব ছিল একখানা খেজুর পাতার বিছানা আর একটি পানির সুরাহি। অনেক দিন তাঁকে অনাহারে থাকতে হত এবং অনেক সময় উনুনে জ্বলত না আগুন।

হজরতের চরিত্রে সংমিশ্রণ হয়েছিল কোমল আর কঠোরের। বিশ্বাসে যিনি ছিলেন অজেয়, অকুতোভয়, সত্যে ও সংগ্রামে যিনি বজ্রের মতো কঠোর, পর্বতের মতো অটল, তাঁকেই আবার দেখতে পাই- কুসুমের চেয়েও কোমল। বন্ধু-বান্ধবের জন্য তাঁর প্রীতির অন্ত নেই মুখ তাঁর সব সময় হাসিহাসি, ছেলেপিলের সঙ্গে মেশেন তিনি একেবারে শিশুর মন নিয়ে পথে দেখা হলে বালক-বন্ধুকে তার বুলবুলির খবর জিজ্ঞেস -করতে তাঁর ভুল হয় না। বন্ধুবিয়োগে চক্ষু তাঁর অশ্রুসিক্ত হয়। বহু দিন পর দাই-মা হালিমাকে দেখে 'মা আমার, মা আমার' বলে তিনি আকুল হয়ে ওঠেন। মক্কাবিজয়ের পর সাফা পর্বতের পাদদেশে বসে হযরত বক্তৃতা করছিলেন। একজন লোক তাঁর সামনে এসে ভয়ে কাঁপতে লাগল। হজরত অভয় দিয়ে বললেন: "ভয় করছ কেন? আমি রাজা নই, কারও মুনিবও নই এমন মায়ের সন্তান আমি, শুষ্ক খাদ্যই যাঁর আহার্য।”

হজরত জীবনে কাউকে কড়া কথা বলেননি কাউকে অভিসম্পাত দেননি। আনাস নামক এক ভৃত্য দশ বছর হজরতের চাকরি করার পর বলেছেন এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে হজরতের মুখে তিনি কড়া কথা শোনেননি কখনো। মক্কায় বা তায়েফে অত্যাচারে জর্জরিত হয়েও হজরতের মুখে অভিসম্পাতের বাণী উচ্চারিত হয়নি। বরং তিনি বলেছেন, "এদের জ্ঞান দাও প্রভু এদের ক্ষমা করো।"
জগতে সাম্যের প্রতিষ্ঠা মোস্তফা চরিত্রের অন্যতম বিশেষত্ব। প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও দাস-ব্যবসায়ের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে মানবাত্মা যখন গুমরে মরছিল, রাসুলুল্লাহ্ (স.) তখন প্রচার করেন সাম্যের বাণী।

সমগ্র জীবন দিয়ে তিনি সাম্যের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। চরম দুরবস্থার হাত থেকে দাসদের পরিত্রাণের জন্যও তিনি কাজ করেছেন। মানুষকে সালাতে আহ্বান করার জন্যে মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করেছেন হাবশি গোলাম হজরত বেলালকে।

নারীর অবস্থার পরিবর্তন এনেছেন হজরত। নারীর মর্যাদা ছিল তাঁর শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। তাঁর কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.)-কে কেন্দ্র করে সে যুগে গড়ে উঠেছে নারীত্বের আদর্শ। হজরত ঘোষণা করেছেন: “বেহেশত মায়ের পায়ের নিচে।”

কুসংস্কারকে হজরত কোনো দিনই প্রশ্রয় দেননি। একবার হজরতের পুত্রের মৃত্যুদিনে সূর্যগ্রহণ দেখা যায়। লোকে বলাবলি করতে থাকে বুঝি হজরতের বিপদে প্রকৃতি শোকাবেশ পরিধান করেছে। তখনি সভা ডেকে হজরত এই বাস্তবতাবিরোধী কথার প্রতিবাদ করলেন; বললেন, “আল্লাহ্র বহু নিদর্শনের মধ্যে দুটি চন্দ্র ও সূর্য। কারুর জন্ম বা মৃত্যুতে চন্দ্র সূর্যে গ্রহণ লাগতে পারে না।”

হজরত জ্ঞানের ওপর জোর দিয়েছেন সব সময়। জ্ঞান যেন হারানো উটের মতো তাকে তিনি খুঁজে বের করতে বলেছেন যেখান থেকেই হোক। আরও বলেছেন তিনি: “জ্ঞানসাধকের দোয়াতের কালি শহিদের লহুর চাইতেও পবিত্র।”

এভাবে জ্ঞানের আলোয় মানুষের হৃদয় উজ্জ্বল করার প্রেরণা দিয়ে গেছেন তিনি।

(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)

common.content_added_by

শব্দার্থ ও টীকা

50
50

মরু-ভাস্কর- মরুভূমির সূর্য। এখানে হজরত মুহাম্মদ (স.)-কে বোঝানো হয়েছে।
সৌষ্ঠব- সুগঠন।
হাদিস- হজরত মুহাম্মাদ (স.)-এর অনুমোদিত বাক্য ও কাজের সমষ্টি।
কষ্টিপাথর- ঘষে সোনা পরীক্ষা করার এক রকম কালো পাথর।
সুরাহি- পানির এক রকম পাত্র, সোরাই, জলের কুঁজো।
অকুতোভয়- যার কোনো কিছুতে ভয় নেই, নির্ভীক।
অভিসম্পাত- অভিশাপ।
পরিত্রাণ- মুক্তি।
হাবশি গোলাম- আবিসিনিয়ায় (বর্তমানে ইথিওপিয়া) জন্মগ্রহণকারী ক্রীতদাস।
লহু- রক্ত।

common.content_added_by

পাঠের উদ্দেশ্য

50
50

মহামানবদের প্রতি শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তোলা।

common.content_added_by

পাঠ- পরিচিতি

51
51

'মরু-ভাস্কর' প্রবন্ধে লেখক মহানবির জীবন ও আদর্শের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন যা আমাদের ধর্মীয় চেতনা ও নৈতিকতার বিকাশে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

হজরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন সেই মহাপুরুষদের মধ্যে একজন যিনি চরিত্রবান; মানবপ্রেমে, জীবপ্রেমে মহীয়ান। বিপদে ধৈর্যশীলতা, দারিদ্র্যে অচঞ্চলতা, শত্রুর প্রতি ক্ষমাশীলতার মহৎ দৃষ্টান্তে তাঁর জীবন সমুজ্জ্বল। অনেক মহাপুরুষের জীবন প্রকৃত তথ্যের চেয়ে কাল্পনিক নানা তথ্যে ভরা। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জীবনের যত তথ্য পাওয়া যায় সবই ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে স্বীকৃত।

আল্লাহর মহান নবি হওয়া সত্ত্বেও হজরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন একজন সাধারণ মানুষের মতো। তাই তিনি মানবজাতির গৌরব।
তাঁর ৬৩ বছরের ঘটনাবহুল জীবনে, নানা পরিস্থিতির মধ্যেও তাঁর জীবনের মূলধারা ছিল অপরিবর্তিত। তিনি সব সময় সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেছেন। তাঁর চরিত্রে মিশে ছিল হাসিখুশি ভাব, কোমলতা ও কঠোরতা। আপন বিশ্বাসে, সত্যের জন্য সংগ্রামে তিনি ছিলেন বজ্রের মতো কঠোর, পর্বতের মতো অটল। কিন্তু নারী-পুরুষ, বন্ধুবান্ধব, শিশু, কিশোর, আত্মীয়স্বজন সবার সঙ্গে ব্যক্তিগত আচরণে তিনি ছিলেন কুসুমের মতো কোমল। তাঁর চরিত্র ছিল প্রীতিতে, ম

মতায়, স্নেহে, সৌজন্যে দয়ার আধার। জীবনে কাউকে তিনি কড়া কথা বলেননি, কাউকে অভিসম্পাত দেননি। নিজে নির্যাতিত হয়েও প্রতিদানে তিনি ক্ষমা করেছেন।

হজরত মানুষে মানুষে ভেদাভেদের পরিবর্তে সাম্যের বাণী প্রচার করে গেছেন। তিনি চরম দুরবস্থা-কবলিত ক্রীতদাসের পরিত্রাণের জন্য কাজ করে গেছেন। নারীর অবস্থার পরিবর্তন ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। অন্য ধর্মের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার ও সহিষ্ণু।

হজরত কুসংস্কারকে কখনো প্রশ্রয় দেননি। যা সত্য, যা যুক্তিগ্রাহ্য, তার পক্ষেই তিনি অবস্থান নিয়েছেন। হজরত জ্ঞানচর্চার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন সব সময়। এর ফলে মুসলিম সমাজ জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়েছে।

common.content_added_and_updated_by

লেখক-পরিচিতি

47
47

হবীবুল্লাহ্ বাহার ছিলেন কবি নজরুলের 'ভক্তশিষ্য' এবং চিন্তা ও কর্মে পুরোপুরি মানবতাবাদী। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফেনী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। মূলত প্রবন্ধকার হলেও তিনি কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন 'ওমর ফারুক', 'আমীর আলী' ইত্যাদি। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৫ই এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

common.content_added_by

কর্ম-অনুশীলন

55
55

ক. মহামানবদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে তাঁদের অনুসরণে ৫টি কল্যাণকর কাজের তালিকা তৈরি কর।

common.content_added_by

নমুনা প্রশ্ন

128
128

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. হজরত মুহাম্মদ (স.) কোন ক্ষেত্রে বজ্রের মতো কঠোর ছিলেন?
ক. গভীর আত্মবিশ্বাসে
খ. নারীর মর্যাদা রক্ষায়
গ. সত্য ও সংগ্রামের চেতনায়
ঘ. সাম্যের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায়

২. 'এদের জ্ঞান দাও প্রভু এদের ক্ষমা কর।'-উক্তিটির মধ্য দিয়ে হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর চরিত্রের কোন বৈশিষ্ট্যটি প্রাধান্য পেয়েছে?
ক. ক্ষমা ও মহানুভবতা
খ. দয়া ও করুণা
গ. প্রেম ও ভালোবাসা
ঘ. বাৎসল্য ও ন্যায়বিচার

৩. 'কারুর জন্ম বা মৃত্যুতে চন্দ্র-সূর্যে গ্রহণ লাগতে পারে না।'- উক্তিটির মধ্য দিয়ে হজরতের কোন ধরনের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে?
ক. সাম্যবাদিতার
খ. মানবপ্রেমের
গ. সংস্কারমুক্তির
ঘ. দৃঢ়বিশ্বাসের

৪. কোন দৃষ্টিকোণ থেকে আরবের লোকেরা ছিল অসাধারণ?
ক. সহিংসতার
খ. ধৈর্যের
খ. পেশিশক্তির
ঘ. স্মৃতিশক্তির

সৃজনশীল প্রশ্ন

১। হজরত মুহাম্মদ (স.) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের কোনো অহমিকা তাঁর ছিল না। মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অফুরন্ত। সকলের প্রতি তাঁর আচরণ ছিল হাসিমাখা। ছোটো শিশুদের তিনি খুব বেশি স্নেহ করতেন। তাঁর বালক-বন্ধুর সাথে দেখা হলে তিনি বন্ধুর বুলবুলি পাখির খবর নিতেও ভুলে যেতেন না।
ক. হজরত মুহাম্মদ (স.) কোন ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন?
খ. শহিদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানসাধকের কলমের কালিকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলার কারণটি ব্যাখ্যা কর।
গ. উদ্দীপকে হজরত মুহাম্মাদ (স.)-এর যে গুণটি ফুটে উঠেছে তা 'মরু-ভাস্কর' প্রবন্ধের আলোকে বর্ণনা কর।
ঘ. "উদ্দীপকটিতে হজরত মুহাম্মাদ (স.)-এর গুণাবলির আংশিক প্রতিফলন ঘটেছে।"-বক্তব্যটির যৌক্তিকতা 'মরু-ভাস্কর' প্রবন্ধের আলোকে বিশ্লেষণ কর।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion